রে ব্রাডবারি ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ উপন্যাস দিয়েই বিশ্বসাহিত্যের উলেখযোগ্য লেখক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন, উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে; এবং তাঁর ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড ম্যান’ এবং ‘দ্য মার্টিয়ান ক্রনিকলস’ নামের গল্প-সংকলন দু’টিও তাঁকে মহৎ সাহিত্য রচরিতার সম্মান এনে দেয়। ব্রাডবারি তাঁর গল্প উপন্যাসকে কখনও শুধুমাত্র কল্প-বিজ্ঞান বলতে চাননি, মূলধারার কথাসাহিত্যে তিনি ভবিষ্যতের কথা বলেছেন, তা যতোটা না কল্প-বিজ্ঞান তারচে বেশি মূলধারার সাহিত্য, যে-কথাটি তাঁর মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমসও আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে। তাঁর ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ উপন্যাসটি ইতোমধ্যে ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে, বিবেচিত হচ্ছে বিশটি শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান বইয়ের একটি হিসেবে। প্রখ্যাত সাময়িকী দ্য প্যারিস রিভিউ ‘লেখার শৈলী’ সম্পর্কিত ব্রাডবারির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে ২০১০ সালের বসন্ত সংখ্যায়, সাক্ষাৎকারী ছিলেন স্যাম ওয়েলার। ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে জন্ম নেওয়া ব্রাডবারি সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের দু-বছর পর মারা যান, ২০১২ সালে, ৯১ বছর বয়সে। এখানে তাঁর প্যারিস রিভিউ সাক্ষাৎকারের বেশিরভাগ অংশ অনূদিত হলো।
আপনি কেন কল্প-বিজ্ঞান লিখেন?
কল্প-বিজ্ঞান হ’ল বীজের সাহিত্য, ধারণা’র কথাসাহিত্য (ফিকশন অফ আইডিয়াস)। বীজ বা ধারণাগুলি আমাকে নানাভাবে আন্দোলিত করে, ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজনা কিংবা তাড়নার জন্ম দেয়, এবং আমি যত বেশি তাড়না অনুভব করতে থাকি, আন্দোলিত হতে থাকি, ততোই আমার শরীরে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তৈরি হতে থাকে; অ্যাড্রিনাল থেকে নিঃসৃত হরমোন আমাকে উত্তেজিত করে ফেলে, এভাবে এর পর কী ঘটবে তা আমি বুঝতে পারি; আমি বুঝতে পারি যে ধারণাগুলি থেকে আমি লেখার শক্তিকে যেন ধার নিয়েছি। কল্প-বিজ্ঞান এমনই এক ধরণের কথাসাহিত্য যা লেখকের মাথায় কোন এক অজানা থেকে জন্ম নেয় যা কোথাও নেই, যার কোথাও কোনও অস্তিত্বই নেই কিন্তু সহসাই যার কথা সবাই জানতে পারবে, এবং সমস্ত কিছুকে সে বদলে দেবে আর সে বদল টি এমন যেখানে কিছুই আর আগের মতো থাকবে না, আগের মতো হবে না। এরূপ ভাবনার সঙ্গে খুব দ্রুতই আপনার মনে এমন এক ধারণার জন্ম হবে যা বিশ্বের কোথাও না কোথাও পরিবর্তন নিয়ে আসবে- তার গূঢ় অর্থই হচ্ছে আপনি কল্প-বিজ্ঞান লিখছেন, আর এটাই হচ্ছে সম্ভাবনার শিল্প, এটি সর্বদা সম্ভব শিল্প, কখনও অসম্ভব না, অসাধ্য কিংবা অসম্ভবের নয়।
একটু কল্পনা করুন, আজ থেকে ষাট বছর আগে, আমার লেখক জীবনের শুরুতে, আমি ভাবছিলাম এমন এক নারীর গল্প লিখব যে একদিন একটি ট্যাবলেট গিলে ফেলেছিল এবং ক্যাথলিক চার্চকে ধ্বংস করেছিল; যা ছিল নারীর স্বাধীনতা ও মুক্তির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নিয়ে আসে। গল্পটি, গল্পের আইডিয়াটি হয়তো অনেককেই হাসাবে কিন্তু দেখুন, গল্পটি কিন্তু কল্পলোকে ছিল, একটা সম্ভাবনার মধ্যে নিহিত, এবং কী দুর্দান্ত এক কল্প-বিজ্ঞান হয়ে যেতে পারত। আমি যদি আঠারো শতকের শেষের দিকে লিখতে আসতাম, তাহলে আমি হয়তো ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন একটি গল্প লিখতে পারতাম যে গল্পে থাকতো অদ্ভুত কিছু গাড়ির কথা যে গাড়িগুলি যুক্তরাষ্ট্রের ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে চলতে শুরু করবে অচিরেই এবং আগামী সত্তর বছর সময়কালে দুই মিলিয়ন লোককে হত্যা করবে। কল্প-বিজ্ঞান শুধু সম্ভাবনার শিল্পই নয়, বরং স্পষ্ট প্রতীয়মান বিষয়ও। একদিন যখন মোটরগাড়ি আবির্ভুত হলো আপনি হয়তো এই আশংকা করেছিলেন যে আগামী দিনে এই যন্ত্রটি বহু মানুষকে ধ্বংস করবে।
কল্পবিজ্ঞান কীভাবে একজন লেখককে চালিত করে?
‘ফারেনহাইট ৪৫১’ নিয়েই বলি। যদি আপনি লিখতেন? উপন্যাসে আপনি বই পোড়ানোর মতো একটি বিষয়কে উপজীব্য করেছেন; বিষয়টি মোটেই মামুলি নয়,- গুরুতর। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে এবং লোকের সামনে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করবেন না। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে। আপনি আপনার গল্পটিকে ভবিষ্যতের কয়েকটি বছরের জন্য রেখেছিলেন এবং ভবিষ্যতের সেই বছরগুলোর ভেতর থেকে আপনি এমন একজন দমকলকর্মী আবিষ্কার করলেন যাকে বই পুড়াতে হবে। এ দুর্দান্ত ধারণা- এবং আপনি দমকলকর্মী লোকটিকে এমনভাবে আবিষ্কার করলেন যে সে একসময় বই পোড়ানোর পরিবর্তে বই পড়তে লেগে যাবে, অর্থাৎ সে বইয়ের প্রেমে পড়ে যায়। সে আর বই পোড়ায় না। তারপর তাঁকে আপনি নিজের জীবনটিকে বদলে ফেলার জন্য সাসপেন্স তৈরি করবেন এবং আপনি বলতে চলেছেন এক মহান সত্যকে, এবং সত্যকে বলছে বিশুদ্ধ থেকে, কোনও ভান না করে।
প্রায়শই আমি পার্সিয়াস আর মেদুসার মাথার রূপকটি ব্যবহার করি যখন কল্পবিজ্ঞানের কথা বলি। সত্যের মুখটি না দেখে, সত্যের মুখের দিকে তাকানোর বদলে আপনি আপনার কাঁধের ওপরের ব্রোঞ্জের ঢালটির দিকে তাকান, মেদুসা যেখানে প্রতিফলিত, ওর মুখের দিকে দেখলে আপনি মুহূর্তে পাথর হয়ে যাবেন, তারপর তরোয়ালসহ ঘুরেই কেটে ফেললেন তার মাথাটি। কল্প-বিজ্ঞান কী করে জানেন- ভবিষ্যতের দিকে নজর দেওয়ার দাবি করে, নজর দেওয়ার ভান করে তবে এ সাহিত্য সত্যিই আমাদের সামনে যা রয়েছে তার প্রতিচ্ছবিটা দেখতে থাকে। এভাবে আপনার কাছে বস্তুর প্রতিফলিত একটা রূপও তৈরি থাকে, এমন এক রূপ যাকে আপনি দারুণ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেন; অধিকমাত্রায় আত্ম-সচেতন এবং অতিমানবিক না হয়ে বরং আপনি তাকে নিয়ে খেলা করতে পারেন।
লেখালেখি শুরু করেছিলেন কখন, কত আগে?
এলান পো-কে দিয়েই শুরু করেছিলাম। আমি বারো থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর লেখাকে আমি অন্তরঙ্গ পাঠ যাকে বলে, তা করেছি। পো’র প্রতিটি লেখায় যে হীরা জহরত আমি পেয়েছিলাম, তার প্রেমে পড়েছিলাম। তিনি নিজেও এমন এক রত্ন যিনি থাকেন কঠিন খোলসের ভেতর, তাই না? পো’র মতোই এডগার রাইস বারোজ জন কার্টারের লেখাও আমাকে তাড়িত করেছে। তাছাড়া আমি পরম্পরাবাহিত যেসব ভীতিপ্রদ (হরর) গল্পগুলি আছে, সেসবও পড়েছি, যে গল্পকথায় ছিল এমন কিছু মানুষ যারা পথ হারিয়ে ফেলে, সমাধিস্তম্ভে আটকে যায়। মিশরীয় গোলকধাঁধাও আমার লেখালেখিকে উস্কে দিয়েছে যা ছিল অদ্ভুত।
১৯৩২-এর দিকে, আমার যখন বারো বছর, তখন চারপাশটা আরও বিস্তৃত হয়, তখন পো, কার্টার, বারোজ এবং কমিকস। আমি এক অদ্ভুত কল্পনাপ্রসূত বেতার শো শুনেছি- চন্ডু দ্য ম্যাজিশিয়ান। আমি নিশ্চিত যে ‘চন্ডু দ্য ম্যাজিশিয়ান’ অনেকের কাছেই ছিল এক নেশাখোর চরিত্র, বেশ বিরক্তিকর জঞ্জাল; তবে, আমার কাছে তার অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা ছিল। প্রতি রাতে শো’টি যখন শেষ হয়ে যেত আমি তখন বসে বসে স্মৃতি থেকে পুরোটাই খাতায় লিখে ফেলতাম। পাণ্ডুলেখ্য তৈরি করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। আলজিয়ার্সের ম্যজিশিয়ান চন্ডু সারা দুনিয়ার খলনায়কদের বিপক্ষে ছিলেন এবং তার মতো আমিও বিপক্ষে ছিলাম! তিনি খলনায়কদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতেন এবং তার মতো আমিও এই কাজটি করতাম!
আমি বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করতাম, ততোদিনে কার্টুনিস্ট বনে গিয়েছিলাম। শিল্পী হিসেবে আমার নিজস্ব এক আঁকার ঢঙ ছিল, রীতি ছিল যা ছিল দারুণ মজার, হাস্য-রসাত্মক। সুতরাং আমি কেবল টারজানকেই যে চিত্রিত করছিলাম তাই নয়, রবিবারের কমিকসগুলোতেও রেখা আঁকছিলাম; আরও ছিল কিছু অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, যার কেন্দ্রে ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, করেছি, সেগুলি দক্ষিণ আমেরিকা, অ্যাজটেক কিংবা বা আফ্রিকার রহস্যময়তায় রোমাঞ্চকর যাত্রা। আর রূপবতী সব তরুণী আর সেখানে সবসময় সুন্দর মেয়ে এবং তাদের বিসর্জন। আমার সব সময়ই মনে হতো যে আমি শিল্পের পথেই হাঁটছি- আমি আঁকছি, অভিনয় করছি, লিখছি…
প্রুস্ত, জয়েস, ফ্লয়েবার, এবং নবোকভের মতো লেখক সম্পর্কে কী বলবেন যারা লেখার শৈলী এবং আঙ্গিকের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ? তাদের লেখার বিষয় আশয়ের প্রতি কখনও আগ্রহী হয়েছিলেন?
না। যদি তাদের চরিত্ররা আমাকে ঘুম পারিয়ে দেয় তাহলে আসলে এই লেখকরাই আমাকে ঘুম পাড়ায়। হায় ঈশ্বর, আমি প্রায় সময় প্রুস্তকে পড়ার চেষ্টা করেছি, তার শৈলীর (স্টাইলের) সৌন্দর্য দেখেছি, তবে কি না- তিনি আমাকে গভীর ঘুমে তলিয়ে দেন। জয়েসের ক্ষেত্রেও তাই বলবো। জয়েসের মধ্যে বহু ‘আইডিয়া’ নেই। দেখুন, আমি কিন্তু সম্পূর্ণরূপেই আমি পুরোপুরি ‘আইডিয়া ওরিয়েন্টেড’; আমি কিছু ফরাসি এবং ইংরেজি গল্প বলার নির্দিষ্ট ধরণ থেকে মুগ্ধ হই, তাদের কুশলতাকে অভিবাদন জানাই, প্রশংসা করি। আমি কেবলমাত্র পৃথিবীতে অস্তিত্ববান একথাও যেন কল্পনা করতে পারি না তেমনি আইডিয়াগুলো আমাদের সঙ্গে কী কী করছে সে সম্পর্কে মুগ্ধও হতে পারি না।
আপনার জনপ্রিয় গল্পগুলির একটি হলো ‘দেয়ার উইল কাম সফট রেইনস’; গল্পটি একটি যন্ত্রচালিত ঘর নিয়ে যা আণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরেও চালু ছিল, অব্যাহতভাবে। গল্পটিতে একজনও মানুষ ছিল না। এই গল্পের বীজ কোথায় পেয়েছিলেন?
হিরোশিমায় আণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরে আমি একটি ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম যেখানে অসংখ্য মানুষের ছায়া সহ একটি বাড়িকে পাশ থেকে তুলে আনা হয়েছিল যে মানুষরা এখানে বসবাস করত, তারা এবং বাড়িটি, এবং বাড়ির দেওয়াল বোমার আগুনে পুড়ে গেছে। কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের ছায়াগুলো এখনও রয়ে গেছে! ফটোটি আমাকে আক্রান্ত করেছিল, এতোতাই আক্রান্ত করেছিল যে গল্পটি না লিখে আমার আর কোনও উপায় ছিল না।
কল্পবিজ্ঞান এমন কী করতে পারে এমন জায়গায় যেতে পারে যা মূলধারার লেখা করতে পারে না?
হ্যাঁ, এমন হয়ে চলেছে, এটা হয়; কারণ- গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের সংস্কৃতির আমাদের সমাজের যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে, মূলধারা সে পরিবর্তনকে উপেক্ষা করেছে, যথাযথ মনোযোগ দেয়নি। আমাদের সময়ের প্রধান আইডিয়াগুলো- জীবনরক্ষাকারী ওষুধগুলোর উন্নয়ন মানে চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ সাধনে, প্রজাতিসমূহের বিকাশের লক্ষ্যে মহাকাশে অনুসন্ধানের গুরুত্ব- এসব জরুরী বিষয় নিরাধারা উপেক্ষিত হয়েছে। সমালোচকরাও এসব কিছু বুঝতেই পারেন নি, তারা বরাবর পনেরো বিশ বছর পিছিয়ে আছেন। এ এক মহান লজ্জা। তারা মহান কিছু মিস করে গেলেন। ‘আইডিয়ার কথাসাহিত্য’-কে কেন এত অবহেলা করা হবে- এ আমার বোধগম্য নয়। ‘বুদ্ধিবৃত্তিক অবজ্ঞার মানসিকতা’ বলা ছাড়া অন্য কিছুতেই এ অবহেলাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না।
আপনি কি কোনও আদর্শ পাঠক কিংবা নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠীর জন্য লিখেন?
যতবারই আপনি নির্দিষ্ট কারও জন্য লেখেন না কেন, সে যে-ই হোক না কেন, আপনি যে আসলে তারই জন্য লিখছেন সে বিশ্বাস আপনি করতেই পারবেন না; বিশ্বাস করছেন মানেই আপনি মিথ্যা বলছেন। তিরিশের দশকের মহামন্দার প্রেক্ষাপটে যারা উপন্যাস লিখেছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র স্টেইনব্যাকের মতো লেখকই এখনও বিপুল পাঠকের কাছে আদৃত, পঠিত। (স্টেইনব্যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক। ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার প্রেক্ষাপটে তিনি এক আলোড়নসৃষ্টিকারী উপন্যাস লিখেন- দ্য গ্রেপস অব র্যাথ। ১৯৬৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয় করেন। এ মন্দা শুরু হয় ১৯২৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৩০-এর শেষের দিকে। এই মন্দা বিশ শতকের দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলা ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী মন্দা। এ মহামন্দাকে বিশ্ব-অর্থনীতির পতনের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়)। স্টেইনব্যাক কিন্তু কোনও কিছুর কারণ নিয়ে উপন্যাস লিখেন নি, তিনি শেষ পর্যন্ত মানুষের গল্প বলেছেন যা সেইসব ঘটনাকে উপস্থাপন করে ভিন্নভাবে, ভিন্ন আঙ্গিকে। দ্য গ্রেপস অব র্যাথ (১৯৩৯) এবং তাঁর অন্যান্য বইগুলি কোনও রাজনৈতিক আলোচনাগ্রন্থ নয়। ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ একদিন থেকে রাজনৈতিক হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়, অর্থাৎ রাজনৈতিক বই নয়; কারণ- বইটিতে যা কিছু কথা বলেছি, সমস্ত আবেগ দিয়ে যে কথাটি বলেছি, তা হচ্ছে- সকলে প্রত্যেকে একা, সকলেই সকলকে একা করে ফেলছে!
আপনি কোথায় বসে লেখেন?
কোথায় বসে লিখছি- এটা তেমন কোনও বিষয়ই নয়। আমি যেকোনও জায়গায় লিখতে পারি। লস অ্যাঞ্জেলেসে আমাদের সেই ছোট্ট বাড়িতে যখন মা বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে বেড়ে উঠছিলাম তখন যে কোনও কক্ষে বসে লিখতাম। বাড়িতে বসার ঘরের টাইপরাইটারে একটানা লিখতে যেতে পারি যখন পাশেই রেডিওটি বেজে চলেছে এবং একই সঙ্গে বাড়ির সবাই কথা বলছে। আরও পরে, যখন আমি ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ লেখা শুরু করব ভাবছি, একবার লস অ্যাঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ে বেজমেন্টে একটি লেখা টাইপ করা যাবে এমন একটি কক্ষের সন্ধান পেয়েছিলাম যেখানে আপনি যদি টাইপরাইটারে দশ পয়সা প্রবেশ করান তাহলে আপনি আধা ঘণ্টা টাইপ করার সময় কিনতে পারবেন।
সঙ্গে নোটবুক রাখেন?
না। লেখার বীজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি লিখে ফেলতে চাই, দেরি হোক এটা চাই না- গল্পটি লিখতে শুরু করে দিই কিংবা সেটা একটা উপন্যাসও হতে পারে অথবা একটি কবিতা। সুতরাং আমার নোটবুকের দরকারই নেই। আমি কিছু লেখার খসড়া করে রেখেছিলাম, কিছু খসড়া কিছু স্কেচ- বছরখানিক আগে কিংবা ধরুন আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে বা দশ বছর আগে করে রাখা এসব খসড়া নিয়ে আমি নানা কারণে বসতে পারছিলাম না। এখন যখন তাদের কাছে ফিরে আসি, উঁকি মেরে তাদের দেখি, খসড়া গল্পের নামগুলি দেখি, নিজেকে সেই পাখিটির মতো মনে হয় যে পাখিটি মুখে আধার নিয়ে তার বাচ্চাদের কাছে ফিরে এসেছে। মা পাখির মতো লেখক যেন ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলির চঞ্চুর দিকে তাকিয়ে আছেন- খসড়া গল্পগুলো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে আর আপনি তাদেরকে বলছেন তোমাদের মধ্যে কাকে এখন খাওয়াব? কে বেশি ক্ষুধার্থ? তখন যে খসড়া গল্পটি সবচেয়ে জোরে চিৎকার করে উঠবে, যে বীজটি খাবারের জন্য বেশি করে মুখ হা করবে তাকেই খাওয়াবেন। আমি সেই গল্পটিকেই ফাইল থেকে টেনে এনে কয়েক ঘন্টার মধ্যে শেষ করি।
লেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় আছে?
লেখার প্রতি অদম্য টানই আমাকে প্রতিটি দিন টাইপরাইটারের কাছে নিয়ে আসে এবং এভাবেই বারো বছর বয়স থেকে এমন চলছে। ফলে আমাকে কখনওই লেখার সময়সূচি নিয়ে চিন্তিত হতে হয় না। সব সময়ই কিছু না কিছু নতুন ব্যাপার নতুন বিষয় আমার ভেতর টগবগ করতে থাকে, বিস্ফোরণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে এবং এই বিষয়গুলোই আমাকে বেঁধে রাখে আমার সময়সূচি ঠিক করে দেয়, আমি কিছুই করি না। লেখার বিষয়ই আমাকে বলে দেয় যে তুমি এখনই টাইপরাইটারের কাছে যাবে এবং এখনই লেখাটি শেষ করতে হবে।
লেখার কাজে কখনও কম্পিউটার ব্যবহার করেছেন?
পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সব সময়ই টাইপরাইটার ব্যবহার করেছি। আইবিএম সেলেক্ট্রিক টাইপরাইটার। কম্পিউটার তো টাইপরাইটারই। তাহলে কেন আমার আরেকটি টাইপরাইটারের দরকার হবে? একটা তো আছেই!
বেশিরভাগ লেখকই বলবেন যে কম্পিউটারে লেখাকে বারবার সংশোধনের সুবিধা আছে, বারবার দেখার সুবিধা আছে। কাটাকুটি সম্পাদনা এসব খুব সহজেই করা যায়। শব্দের ভুল বানান সংশোধনের কথা এখানে উল্লেখ না-ই করলাম।
আমি তো সত্তর বছর ধরে লিখছি, আমি যদি এখনও জানি না কীভাবে একটি শব্দ নির্ভুল লিখতে হয়…
‘লেখার শৈলীর স্পন্দ-প্রবাহ’ (দ্য আর্ট অফ রাইটিং) বইয়ে আপনি লিখেছেন- লেখক জীবনের শুরুর দিকে আপনি বিশেষ্যের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন যেন গল্পের আইডিয়াগুলোকে বিস্তার করবার জন্য, যেমন: বয়াম, চৌবাচ্চা, হ্রদ, কঙ্কাল। এখনও এমনটা করেন?
এখন আর এতো নয় কারণ আমি এখন অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইডিয়ার বিস্তার করতে পারি, কিন্তু পুরোনো দিনগুলোয় মনে হতো আমি অবচেতনকে বা মগ্নচৈতন্যকে খুঁড়ছি, অবচেতন বা মগ্নচৈতন্য থেকে বের করার চেষ্টা করছি যেভাবে নদীতলদেশ থেকে কাদামাটি তোলা হয়, আর বিশেষ্যগুলোও তাই করছিল। লেখালেখির শুরুতে এসব করতে শিখেছিলাম। তিনটি জিনিস সব সময় লেখকের মাথায় আছে : প্রথমত, জন্মের দিন থেকে আজ অবধি যা কিছু দেখেছেন, যা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি দিনের অভিজ্ঞতা। তারপরে, এই যে এত এত দিন এই কিছু ঘটে গেল, ঘটার মুহূর্তে ঘটনাগুলোর প্রতি আপনি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, সে ঘটনাগুলো হতাশাজনক কিংবা আনন্দদায়ক, যা-ই হোক।
এ দুটি জিনিস যদি আপনার মাথায় থাকে আপনাকে লেখার উপকরণ বা কাঁচামাল যোগান দেবে। তারপরে, জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনি আপনার সমস্ত শিল্প-অভিজ্ঞতা থেকে পৃথক করে নেবেন যা আমরা অন্যান্য লেখক, শিল্পী, কবি, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সুরকারদের কাছ থেকে শিখেছিলাম। সুতরাং এবার আপনি মনের ভেতর খুঁজে পাবেন এমন এক ভূমি যাকে ঢেকে রয়েছে এমন কিছু পড়ে থাকা পাতালতা যাকে বলবো সৃজনী সংরাগ আর আপনাকে নিজের ভেতর থেকে তা বের করে। কিন্তু বের করাটা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায়?
জানেন আমি কী করতাম? আমি বিশেষ্যর তালিকা তৈরি করতাম, তারপর প্রশ্ন করতে শুরু করতাম- এগুলোর মানে কী? আপনি এখন যান, গিয়ে নিজের জন্য একটি তালিকা তৈরি করুন, দেখবেন আপনার তালিকাটি আমার তালিকা থেকে ভিন্ন হয়েছে। রাত। ঝিঁঝিঁ। ট্রেনের হুইশ্যল। চিলেকোঠা। খেলার জুতো। আতশবাজি। ভূগর্ভস্থ ঘর- তালিকার সমস্তকিছুই একান্ত ব্যক্তিগত। তারপর, তালিকা করা শেষ হলে এক একটি বিশেষ্য ঘিরে, তার চারপাশে জরুরি শব্দগুলোকে জড়ো করতে শুরু করবেন। তখন আপনি জিজ্ঞাসা করবেন- কেন আমি এই শব্দটি লিখেছি, কেন ওই শব্দটি বসিয়েছি? আমার কাছে এসব শব্দের অর্থ কী, কী মানে? কেন আমি এই বিশেষ্যটি তালিকায় রেখেছি, অন্য কোনও শব্দ কেন নয়? অন্য কিছু শব্দ তো লিখতে পারতাম!
এভাবে করতে থাকুন, এর অনিবার্য ফল আপনি একজন ভালো লেখক হওয়ার পথে আছেন। আপনি অন্য কারও জন্য লিখতে পারবেন না। ডান কিংবা বাম, এ ধর্ম বা সে ধর্ম, এ-বিশ্বাস সে-বিশ্বাসের জন্য লিখতে পারবেন না। আপনাকে লিখতে হবে জিনিসগুলোকে ঠিক যেভাবে দেখছেন ঠিক সেভাবে। আমি অনেককেই বলি, এমন দশটি জিনিসের তালিকা করুন যাদের ঘেন্না করেন এবং একটি গল্প কিংবা কবিতা লিখে ফেলুন। প্রিয় দশটি জিনিসের একটি তালিকা তৈরি করুন এবং তাদের সেলিব্রেট করুন। আমি যখন ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ উপন্যাসটি লিখছিলাম, তখন যারা বই পুড়িয়ে ফেলত তাদের প্রচণ্ড ঘৃণা করছিলাম এবং গ্রন্থাগারগুলোকে ভালোবাসছিলাম কেননা লেখক হিসেবে আপনি কেবলমাত্র গ্রন্থাগারেই থাকবেন। আপনার জায়গা সেখানে।
তালিকা তৈরির পর আপনি কীভাবে কাজ করেন?
বিশেষ্যগুলো সম্পর্কে আমি আমার ভাবনা কাগজে লিখতে শুরু করি গদ্য কবিতার মতো। আমাকে জাগায়, উস্কানি দেয়, উদ্দীপ্ত করে। রূপকের জন্ম হয়। স্যাঁ-জন পার্সের এই ধরণের কবিতার বেশ কয়েকটি খণ্ড বেরিয়েছিল। প্রকাশক অত্যন্ত সুন্দর করে দামি কাগজে ছেপেছিলেন। পার্সের কবিতাবইগুলোর নাম ছিল- বৃষ্টি, তুষার, বাতাস, পাখি, নির্বাসন, দান্তে। সামর্থ্য কুলোতো না বলে আমি কখনও পের্সের বই কিনতে পারিনি। এক একেকটি বইয়ের দাম ছিল বিশ থেকে ত্রিশ তিরিশ ডলারের মধ্যে। আমি মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের কথা বলছি! পের্স আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, বইয়ের দোকানে গিয়ে তার বই আমি পড়তাম আর তাঁকে পড়ার ফলে আমিও ছোটো কিন্তু বর্ণানাত্মক অনুচ্ছেদগুলো লিখে ফেলতাম- প্রতিটি দু’শো শব্দের। তারপর এই লেখাগুলোর মধ্যে আমি আমার বিশেষ্যগুলোকে নিয়ে নিরীক্ষা করতে শুরু করতাম; তারপর- এই বিশেষ্য সম্পর্কে কথা বলবার জন্য চরিত্রদের নিয়ে আসতাম, তারা বিভিন্ন নাটকীয় কথা বলতে শুরু করতো, কীভাবে কীভাবে যেন একটা গল্প শুরু হয়ে যেত। মসৃণ ও চকচকে কাগজে ছাপা ম্যাগাজিনগুলোয় ছাপা ছবিগুলো আমি ছিঁড়ে ফেলতাম, তারপর তাদের নিয়েও ঠিক একই ভাবে কাজ করতাম। ছবিগুলো নিয়ে গদ্য কবিতা- অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ।
কিছু কিছু ছবি ভেতরে অতীত জাগিয়ে দেয়, উস্কানি দিতে থাকে; উদ্দীপ্ত করে। আমি যখন এডওয়ার্ড হোপারের চিত্রগুলি দেখি, তখন আরও বেশি আক্রান্ত হই। মধ্যরাতের নিঃসঙ্গ ক্যাফে, নিঃসঙ্গ থিয়েটার আর একজন কি দু’জন মাত্র মানুষ- কী বিস্ময়কর টাউনস্কেপগুলো তিনি এঁকেছেন! তিনি করতে পেরেছেন। তাঁর বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের বোধটি দুর্দান্ত। আমি কাজগুলো গভীর মনোযোগে দেখতাম আর তাদের আমি আমার নিজের কল্পনায় পূর্ণ করতাম প্রতিদিন। আমার কাছে এখনও এসব ভাবনা রয়ে গেছে। কাগজে লিখে ফেলবার মতো ভাবনা। আমি যা, যা আমার থেকে শুরু হবে, তা ছিল এসব। নিজেকে নিংড়ে নিয়ে এভাবেই আমার লেখক জীবনের যাত্রা শুরু হয়।
নিজের কোন গল্পটি নিয়ে লেখক হিসেবে আপনি গর্বিত?
লেখক জীবনের যে কোনও পর্বে লিখিত হওয়া আমার খুব প্রিয় গল্পের একটি হলো ‘দ্য টয়োনবি কনভেক্টর’। গল্পটি এমন এক মানুষকে নিয়ে, যিনি বিশ্ববাসীকে একটা কিছু অনুভব করাতে চান, উপলব্ধি করাতে চান যে তিনি একটি টাইম মেশিন উদ্ভাবন করেছেন এবং তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন, আর আমরা যদি নিজেদেরকে পরিবর্তন না, জীবন প্রাণালীতে পরিবর্তন না আনি, তাহলে এ পৃথিবী অচিরেই জাহান্নামে যাবে। অবশ্যই এ এক বিরাট মিথ্যা কিন্তু তবু লোকেরা তাকে বিশ্বাস করে। গল্পের সে লোকটি আমিই, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লোকজনকে সতর্ক করছি।
লেখালেখিকে আপনি উপভোগ করছেন কি না- আমি মনে করি এটা জিজ্ঞাসা করারই প্রয়োজনীয়তা নেই।
দারুণ, দারুণ উপভোগ করি। লেখালেখিই আমার জীবনের অপূর্ব আনন্দ; এবং, উন্মাদতা, পাগলামি যা-ই বলুন- একমাত্র, এবং একমাত্র এই লেখালেখি। আমি অন্য লেখকদের একারণেই বুঝতে পারি না যারা লেখালেখিকে কাজ হিসেবে নিয়েছেন! আমি খেলতে ভালোবাসি। লেখার বীজ বা আইডিয়া নিয়ে আমি নিজে নিজে মোজা করতে পছন্দ করি। উৎসবের রঙিন কাগজের টুকরোর মতো আমি বীজগুলোকে, আইডিয়াগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দিতে চাই, তারপর তাদের পিছু ধাওয়া করি, দৌড়ে তাদের ধরতে চাই। লেখালেখিকে আমি যদি কাজ হিসেবে নিই, তাহলে এ কাজ আমি ছেড়ে দিব। আমি কাজ পছন্দ করি না।
লেখার প্রথম খসড়াটি, যেমনটা আপনি প্রায়শই বলে থাকেন- মূলত, আপনার অবচেতন পৃষ্ঠাটিতে কথা বলে চলেছে, তাহলে পুনর্লিখনের পর্যায়ে লেখাটি কি অবচেতন থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনার দিকে নিয়ে আসেন?
নিশ্চয়ই। লেখাটির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি কতকিছু কাটছি, কেটে বাদ দিচ্ছি। আমার বেশিরভাগ ছোটগল্পই বেশ দীর্ঘ। আমি যখন ‘সামথিং উইক্ড দিস ওয়ে কামস’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, সে উপন্যাসের প্রথম খসড়ায় শব্দ ছিল দেড় লাখ, পরে সম্পাদনার সময় পঞ্চাশ হাজার কেটে বাদ দেই। লেখালেখিতে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- আপনাকে আপনার নিজের পথটি খুঁজে নিতে হবে। জ্বলজ্বল করতে থাকা আবর্জনা ছেঁটে ফেলুন। লেখাটা দাঁড়িয়ে যাবে।
যে কোনও লেখা আপনি একটানে লিখেন, দ্রুত; পরে, সে লেখার সম্পাদনাও কি দ্রুত করে ফেলেন?
না। লেখার প্রথম খসড়াটি আমি খুব দ্রুতই লিখি, সে দ্রুত গতিতে প্রচণ্ড অন্তরাবেগ থাকে, ভেতর থেকে কিছু একটা আমাকে তাড়িত করে। তার কিছুদিন পর পুরো লেখাটি আমি পুনরায় টাইপ করি আর তখন আমার অবচেতন, যখনই আমি লেখাটিকে দ্বিতীয়বারের মতো টাইপ করছি, অর্থাৎ লিখছি, আমার অবচেতন আমাকে এমন কিছু শব্দ উপহার দেয়, যা প্রথম খসড়ায় ছিল না। এভাবে লেখাটি সম্পূর্ণ না দাঁড়ানো পর্যন্ত পুনর্টাইপ চলতেই থাকে; এভাবে বেশ কয়েকবার ধরে হয়তো লিখিত হতে থাকবে লেখাটি। কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে অবশ্য খুব বেশি একটা ঝামেলা হয় না, অল্পই সংশোধন করা লাগে।
দিনের ঠিক কোন সময়টায় লেখায় বেশি ডুবে থাকেন?
আমি সব সময়ই লিখি, সারাদিন ধরে। আজ কী লিখতে যাচ্ছি এটা না জেনেই প্রতিদিন ভোরে আমি জেগে উঠি আর লেখার জন্য বসে পড়ি, তবে, হ্যাঁ, প্রতিদিনই একটা লেখা মাথায় নিয়ে আমার ঘুম ভাঙে, লেখা মানে লেখার আইডিয়া বা বীজ যা-ই বলেন, যেন মাথার ভেতর একটা থিয়েটার চলছে, নাটকের চরিত্ররা আমার সঙ্গে কথা বলছে, সমস্ত কণ্ঠ আমার সঙ্গে কথা বলছে…সমস্ত কিছু মিলিয়ে একটি রূপক বা মেটাফর যখন ঘনীভূত হয়ে ওঠে, তখনি আমি এক লাফে বিছানা ছাড়ি; থিয়েটারের কণ্ঠগুলো পালিয়ে যাওয়ার আগেই লেখার ফাঁদে তাদের আটকে ফেলি। আমার গোপন রহস্য হচ্ছে- : এমন কিছু লেখো যা কাউকে তাড়িত করবে, নাড়িয়ে দেবে; উত্তেজিত করবে। লিখতে লিখতে, আমি হয়তো আবারও ঘুমিয়ে পড়ব। এভাবে প্রতিদিন দু’বার আমার ঘুম ভাঙবে; এভাবে প্রতিদিন আমার জীবনে দু’বার ভোর হবে।